এম.পি.সার্কেল, নাগরিক প্রতিক্রিয়া ডেক্স:
বাঙালিত্ব তথা বাঙালির সংস্কৃতির পরিচয় ধারণ করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছিল উনিশশ’ একাত্তরে। ধর্মের অপব্যাখ্যা করে বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর যে আঘাত তারা করেছিল তার প্রকাশ নানাভাবে ঘটেছিল। বাঙালির বর্ষবরণ উৎসব তাদের চক্ষুশূল হয়েছিল, সামরিক শাসকের বশংবদ গভর্নর আবদুল মোনায়েম খান বিষোদ্গার করে বলেছিলেন যে, প্রভাতী সংগীতায়োজনের মধ্য দিয়ে ছায়ানট সূর্যপ্রণাম করছে। আব্বাসউদ্দিন আহমদের কন্যা গুণী সংগীতশিল্পী ফেরদৌসি বেগমকে পাকিস্তান টেলিভিশন বারণ করেছিল টিপ পরে গান পরিবেশন করা যাবে না। তিনি ধর্মপরায়ণ বাঙালি, ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে যে কোনো বিরোধ নেই, এই অবস্থানে ছিলেন অটল। তার সঙ্গে ছিল সমাজের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষরা এবং পাকিস্তানিরা পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল। বর্ষীয়ান পণ্ডিত ও ইসলামের দর্শনে ডুব দেয়া ব্যক্তিত্ব ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, ‘মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে, মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জোটি নেই।’
অমোচনীয় এই জাতিসত্তা নিয়ে এই মাটির সন্তানরা হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নির্বিশেষে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে প্রতিষ্ঠা করেছিল সম্প্র্রীতির রাষ্ট্র বাংলাদেশ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে জাতির পতাকা আজ খামছে ধরেছে পুরনো শকুন। অসাম্প্রদায়িক চেতনার মুক্ত প্রকাশ অবরুদ্ধ ও বিভ্রান্ত করতে চলছে একের পর এক আঘাত, প্রকাশ্যে ও সুকৌশলে। কখনো ভাঙচুর করা হচ্ছে মন্দিরের বিগ্রহ, কখনো বা সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষকের ওপর হামলা করা হচ্ছে। এই আঘাত সুপরিকল্পিত চক্রান্তমূলক রাজনীতির অংশ। আমরা এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে এই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি। এর মোকাবিলায় মানবতা, সত্য ও সম্প্রীতির ভাবনা ও কর্মধারা বহুভাবে জোরদার করে তোলা অশেষ গুরুত্ববহ।
ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, পশ্চাৎচিন্তা এবং এর সঙ্গে মিথ্যাচার ও ভণ্ডামির মিশেলে জাতিসত্তার ওপর যে বিশাল আক্রমণ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে তার বিপরীতে মানবিক ধর্মচিন্তা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানের প্রসারতা আমাদের কাম্য। মানুষের মন দূষিত করে অপরের বিরুদ্ধে অসহিষ্ণুতা ও সহিংসতা উস্কে দেয়ার পরিণতি আমরা একাত্তরে প্রত্যক্ষ করেছি একাত্তরে, যখন বিশ শতকের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মুসলিম নিধন ঘটেছিল এই মাটিতে তথাকথিত ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সামরিক বাহিনী দ্বারা। মানবতার চরম পদস্খলন হরণ করেছিল ত্রিশ লাখ প্রাণ, বিপর্যস্ত করেছিল অগণিত পরিবারের জীবন। আজ ধর্মের নামে আবারো ছড়ানো হচ্ছে বিদ্বেষ বিষ, যে বিষভাণ্ড থেকে উৎসারিত হয় সহিংসতা। এর বিপরীতে সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানের আলোকে মানবতাবোধে সমাজকে ¯œাত করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ আমরা পৌঁছে দিয়েছি, কিন্তু সংস্কৃতির আলোতে প্রতিটি ঘর স্নাত করার কাজে মনোযোগী হইনি। বিশাল সাংস্কৃতিক জাগরণ দ্বারাই এটা অর্জিত হতে পারে। সবার সম্মিলিত সাধনায় এমনি দায়িত্ব সম্পাদন সম্ভব। সেজন্য সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতি আরো বাস্তবানুগ হতে হবে, এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ মেগা-প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত হতে হবে। অযুত কর্মধারার মধ্য দিয়ে সমাজে হাজারো ফুল ফুটতে দিয়ে আমরা পারব সম্প্রীতির বাংলাদেশকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে। সেই সংগ্রামের ডাক দিচ্ছে বাংলা নববর্ষ, নতুন করে, ফিরে ফিরে।
মফিদুল হক, ট্রাস্ট্রি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর