এম.পি. সার্কেল, সুচিকিৎসা চক্র:
বাংলাদেশে লাগাতার দুই দশকে স্বাস্থ্য খাতের অবকাঠামোগত উন্নতি হলেও অব্যবস্থাপনাজনিত কারণে চিকিৎসা বৈষম্য বেড়েছে। এর ফলে চলমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চিকিৎসা নিতে গিয়ে মানুষের ভোগান্তি কমছে না। চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৭ শতাংশের বেশি ব্যক্তি পর্যায় থেকে মেটাতে হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্য অনেক দেশে যেখানে বিনামূল্যে ও সহজ উপায়ে জনগণকে চিকিৎসা, ওষুধ দেওয়া হয়, সেখানে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে।
এজন্য একটি স্বাস্থ্যনীতি থাকলেও সেটি কার্যকর নয়। এছাড়া অন্যান্য দেশে জিডিপির ২ থেকে ৩ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করা হলেও বাংলাদেশে তা ১ শতাংশেরও কম। ফলে কিছুটা অগ্রগতি হলেও অব্যবস্থাপনা জনিত কারণে পিছিয়ে পড়ছে। সঠিক ব্যবস্থাপনায় এ সমস্যা উত্তরণ সম্ভব হবে।
এমন পরিস্থিতিতেও বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে অন্য বছরগুলোর মতো আজ বাংলাদেশেও নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালিত হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস-২০২২। এবারের প্রতিপাদ্য: ‘আওয়ার প্লানেট, আওয়ার হেলথ (সুরক্ষিত বিশ্ব, নিশ্চিত স্বাস্থ্য।’ দিবসটি উপলক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন। বাণীতে তিনি বলেন, দেশের সব মানুষের জন্য সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সরকার বদ্ধপরিকর। দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য স্বাস্থ্যকর জীবন যাপনের উপযোগী দূষণমুক্ত পরিবেশ গড়ার মাধ্যমে একটি কল্যাণমূলক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করাই বর্তমান সরকারের লক্ষ্য। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় স্বাস্থ্য খাতে ‘রূপকল্প-২০৪১’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলব ইনশাল্লাহ।’
এদিকে বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে, দেশে মাতৃ ও শিশুমৃত্যু কমেছে। কিন্তু স্বাস্থ্যে বৈষম্য বাড়ছে। অনেক মানুষ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় মেটাতে গিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। গড় আয়ু বাড়লেও স্বাস্থ্যসেবা ভালো না হওয়ায় শেষ সময়ে গিয়ে বয়স্করা সমাজ ও পরিবারের বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন।
এজন্য একটি স্বাস্থ্য কমিশন জরুরি হয়ে পড়ছে। তাছাড়া বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের প্রধান কাজ হলো বৈষম্যহীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। সংবিধানেও এটি ভালোভাবে বলা হয়েছে। কিন্তু দেশে কোনো কার্যকর স্বাস্থ্যনীতি নেই। স্বাস্থ্য বাজেট অপ্রতুল, অব্যবস্থাপনা আরও বেশি, যা করোনা মহামারিতে স্পষ্ট হয়েছে। এমডিজিতে স্বাস্থ্য খাতের সাফল্য কেবল সংখ্যায় হয়েছে, বাস্তবে সেটি তেমনটা প্রভাব ফেলেনি।
সাবেক সফল স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক বলেন, ‘স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। অনেক দেশ জিডিপির ২-৩ শতাংশ ব্যয় করে, আমাদের ১ শতাংশেরও কম। তারপরও আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এগিয়েছে, যেটি ইতিবাচক। তবে অনেক অব্যবস্থাপনাও রয়েছে। আমাদের পুষ্টির এখনো ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। এটির পরিবর্তন হওয়া দরকার। আমাদের ব্যক্তি খরচ অনেক বেশি। অভ্যন্তরীণ রোগীরা বিনামূল্যে ওষুধ পেলেও বহির্বিভাগে এখনো এটি সেভাবে করা যায়নি। ফলে এই ব্যয় বেড়েই চলেছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য, জেলা সদর হাসপাতালসহ চিকিৎসার প্রতিটি স্তরে চিকিৎসক সহ প্রয়োজনীয় জনবলের সংকট, সেটিরও সমাধান দরকার।’
তিন আরও বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাস্থ্যে মোট ব্যয়ের ১৫ শতাংশ হওয়া দরকার; কিন্তু সেটিতে আমরা একেবারে পিছিয়ে। ফলে সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। আবার হাসপাতালগুলোয় নানা অব্যবস্থাপনা। অনেক দামি দামি জিনিসপত্র কেনা হয়; কিন্তু সেগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয় না। আছে নিয়োগে অনিয়ম। তারপরও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে দেশের স্বাস্থ্য খাত অনেক এগিয়েছে।’
ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেছেন যে, দেশে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের সবক্ষেত্রে শক্ত নীতিমালা, পরিকল্পনা এবং অবকাঠামো রয়েছে। স্বাস্থ্যকে সংবিধানের মূল অধিকার, প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যা বাস্তবায়নের জন্য মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, প্রতিটি জেলায় হাসপাতাল, থানা হেলথ কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খল অবস্থা দূর হয়নি। মানুষের মাঝেও চিকিৎসক এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা রয়েছে। করোনাকালে এই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অনেক ভগ্নদশা ফুটে উঠেছে।
তিনি বলেন, রোগী বা জনগণের বড় অংশই চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি কমবেশি ক্ষুব্ধ। তাদের অভিযোগ যেমন হাসপাতালে ভালোভাবে চিকিৎসা হয় না, ডাক্তার-নার্স ঠিকমতো দেখে না। চিকিৎসকের উচ্চ ফি, পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কমিশন ও অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া চিকিৎসার খরচও দিনদিন বেড়েই চলছে। হঠাৎ কেউ জটিল রোগে আক্রান্ত হলে তাকে চিকিৎসার খরচ মিটাতে বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে। সরকারি হাসপাতালে খরচ কম হলেও অতিরিক্ত রোগীর চাপে এবং প্রয়োজনের তুলনায় সুযোগ-সুবিধা কম থাকায় প্রত্যাশিত চিকিৎসা পাওয়া সম্ভব হয় না। বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে চিকিৎসা খরচ আকাশচুম্বী, অনেকেরই সামর্থ্যের বাইরে থাকছে। ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের ছড়াছড়ি, পরীক্ষার-নিরীক্ষার মানহীনতা, মেয়াদোত্তীর্ণ রিএজেন্টের ব্যবহারসহ ভুল রিপোর্ট দেওয়ার অভিযোগ আছে।
বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের উপদেষ্টা কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. রওনক জাহান বলেন, স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের যে অর্জন, সেটি আমরা কেবল দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করা হয়। পাশের দেশ নেপালও আমাদের অনেক ছোট মনে করে। থাইল্যান্ডসহ ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে আমরা কতটা এগোতে পেরেছি, সেটি দেখা উচিত। থাইল্যান্ড গত ৬০ বছরে সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পেরেছে। কীভাবে পেরেছে, সেটা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। তাদের সঙ্গে কেন তুলনা করা হয় না।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষ্যে কর্মসূচি :
দিবসটি উপলক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারিভাবে সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হবে। আজ বেলা ১১টায় রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে আলোচনাসভা হবে। স্বাস্থ্যবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যালি ও আলোচনাসভা ছাড়াও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে স্বাস্থ্যবিষয়ক সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও র্যালি, মানববন্ধন, সেমিনারসহ নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।