এমপি সার্কেল, সাক্ষাৎকার ও আলোকায়ন ডেক্স:
বিশ্বখ্যাত সাময়িকী ‘ভোগ’ বিশ্বের ১০০ উদ্ভাবনী উদ্যোগের তালিকা প্রকাশ করেছে। সেই তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন দেশের মানসিক স্বাস্থ্য সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ‘মনের বন্ধু’র প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী তৌহিদা শিরোপা। তিনি ‘সাসটেইনেবিলিটি থট লিডার’ ক্যাটাগরিতে সম্মাননা পেয়েছেন। ‘টমি হিলফিগার ফ্যাশন ফ্রন্টিয়ার’ চ্যালেঞ্জে চলতি বছর বিজয়ী হয় মনের বন্ধু। সম্প্রতি মনের বন্ধু মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে পোশাক শ্রমিকদের জন্য আরও সুলভ ও সাশ্রয়ী করতে স্বল্পমূল্যের সাবস্ক্রিপশন সুবিধাসহ টপআপ কার্ড নিয়ে এসেছে। বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত তৌহিদা শিরোপা’র সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হিটলার এ. হালিম।
বাংলা ট্রিবিউন: সাংবাদিক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু। সেটা ছেড়ে উদ্যোক্তা হলেন। কেন?
তৌহিদা শিরোপা: লেখালেখি থেকে সাংবাদিকতায় এসেছিলাম। ভালোও লাগতো। হঠাৎ ২০১৫ সালে আমার মা অসুস্থ হন। এরপরেই মূলত জীবন সম্পর্কে আমার একটা ভিন্ন উপলব্ধি হয়। প্রথমে আমার মাকে বিভিন্ন রকম চিকিৎসা করিয়েও কোনও ফল হচ্ছিল না। এক পর্যায়ে মনোরোগের ডাক্তার দেখানোর পর আসল সমস্যা ধরা পড়ে। শুরু হয় ১৪ মাসের নতুন এক জার্নি। তখন আমার ভাই ও আমার দু’জনেরই নতুন ক্যারিয়ার। সব মিলিয়ে তখন আমাদের লাইফস্টাইলকে পরিবর্তন করতে হয়েছিল। পরিবারের মানুষদের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়াটা তখন বেশ প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল। আর তখন থেকেই এই বিষয়টার প্রতি আমাদের একটা আগ্রহ তৈরি হয়।
বিষয়টি সম্পর্কে আমরা যখন বিস্তারিত জেনেছি তখন মানুষকে অনেকটা সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যেই যাত্রা করেছিলাম। তখন আসলে উদ্যোক্তা হওয়ার মতো কোনও উদ্দেশ্যও ছিল না। জীবনে ভালো এবং খারাপ সময়কে নিজে উপলব্ধি করে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি। সব মিলিয়ে আমার উদ্দেশ্য ছিল, এমন একটি প্ল্যাটফর্ম করার যেখানে একজন মানুষ নির্দ্বিধায় তার মনের সব বিষয় বিস্তারিত বলতে পারবে এবং তার প্রাইভেসিও সম্পূর্ণ সুরক্ষিত থাকবে।
বাংলা ট্রিবিউন: উদ্যোক্তা হিসেবে বেছে নিলেন মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে। কেন মনে হলো এটা নিয়ে কাজ করা যায়?
তৌহিদা শিরোপা: আমরা সবাই জানি ভালো থাকার জন্য আমাদের কী করতে হয়। কিন্তু সেগুলো আসলে আমাদের প্রায়োরিটির ভেতরে সঠিকভাবে থাকে না। আমরা বিভিন্ন কাজেই সময় দিচ্ছি, যেমন- সোশ্যাল মিডিয়াতে। কিন্তু আত্মীয়স্বজনকে বা পারিপার্শ্বিকতাকে আমরা তেমন সময় দিই না। সাইকিয়াট্রিস্ট বললেন মাকে পর্যাপ্ত সময় দিতে। তিনি যেন কখনও একা না থাকেন। কিন্তু আমি আসলে এই বিষয়টা ঠিক ধরতে পারিনি। পরে বিষয়টা আমাকে মানসিকভাবে বেশ কষ্ট দেয়। এরপর আমি বিষয়টির প্রতি আরও গভীরভাবে মনোযোগী হই। অনেক কিছু পড়া শুরু করি। বিভিন্ন কোর্সও করা শুরু করি। পাশাপাশি বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে গিয়ে আমি এই বিষয়ে কথা বলতে শুরু করেছিলাম। তখন আমারও অনেক স্ট্রেস হয়েছে। মূলত মায়ের সেবা করতে গিয়েই আমার এমন অনেক ধরনের চর্চা হয়ে গিয়েছিল।
প্রথমে আর্থিক বিষয়টা ছিল। আমরা স্কুল কার্যক্রম দিয়ে শুরু করি। এভাবে আস্তে আস্তে মানুষের ভেতরে সচেতনতাও তৈরি হবে। আমরাও একটু একটু করে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারবো। আমি নিজে যেহেতু সাইকোলজি ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসিনি, তাই যারা এটা নিয়ে পড়াশোনা করেছে তাদের কাছে যেতাম। তাদের বলতাম যে এধরনের একটা কাজ আমরা করতে চাই। এরপরে আমরা রেডিও প্রোগ্রামও শুরু করলাম। ২০১৬ সালের শেষের দিকে এসে আমরা রেজিস্ট্রেশন করি। কিন্তু তখন আমরা আসলে অতো কাজ করতে পারিনি। ছোট ছোট দু’-একটা প্রোগ্রাম করেছি স্কুল পর্যায়ে। ২০১৭ সালে কাজের পরিধি আরেকটু বাড়ে। এরপর মূলত ২০১৮ সালে এসে আমাদের মনে হয়েছে আমরা একটা স্টার্টআপের দিকে যাচ্ছি।
বাংলা ট্রিবিউন: মনের বন্ধু কেন? এই নামটা কীভাবে ভাবনায় এলো?
তৌহিদা শিরোপা: আসলে এমন একটা নাম দিতে চেয়েছিলাম যেখানে মানুষ সহজে কানেক্ট হতে পারে। এছাড়া আমরা চেয়েছিলাম নামটা যেন বাংলা হয়। যদিও আমাদের পরিকল্পনা আছে বৈশ্বিক পরিসরে পা রাখার তবে বাংলাদেশে যেন আমরা পুরোপুরি পরিষেবাটি দিতে পারি সেদিকে আমাদের মূল মনোযোগটি থাকবে। আমরা এমন একটি নাম দিতে চেয়েছি যেন মানুষকে খুব একটা বোঝাতে না হয় যে আমরা আসলে কী করি। মানুষ প্রতিষ্ঠানের নাম থেকেই আমাদের প্রতিষ্ঠানকে খুব আপন মনে করে নিতে পারে।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনারা কয়জন মিলে শুরু করলেন?
তৌহিদা শিরোপা: শুরুতে আমার বন্ধু-বান্ধবরা আমাকে সাহস দিয়েছে, উৎসাহ দিয়েছে। এরপরে অনেক মানুষই এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। শুরু থেকে প্রতিষ্ঠাতা ছিলাম আমি।
বাংলা ট্রিবিউন: কখন মনে হলো এটাকে স্টার্টআপ হিসেবে নেওয়া যায়?
তৌহিদা শিরোপা: ২০১৮ সালে এসে মনে হয়েছিল। এছাড়া ২০১৬ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত আমার চাকরির কোনো টাকা, বিশেষ করে ঈদ বোনাস কোনোটিই আমি বাড়িতে দিতে পারিনি। এ বিষয়ে বিশেষ করে আমি আমার মা ও ভাইয়ের কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ।
বাংলা ট্রিবিউন: প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য আপনারা ফান্ড কীভাবে পেলেন? আপনাদের আয়ের মডেলটি যদি বলতেন।
তৌহিদা শিরোপা: ২০১৭ সালের শেষের দিকে আমরা সরকারের আইসিটি বিভাগের আইডিয়া প্রজেক্টে আবেদন করি। বিষয়টি তখন আমাদের এবং সরকার উভয়ের জন্যই নতুন ছিল। বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে আমরা প্রথম ১০ লাখ টাকার একটা অনুদান পাই। প্রথমে দুই লাখ পরে আট লাখ এই দুই ধাপে টাকাটা পাই। এরপরে আমরা কো-ওয়ার্কিং স্পেসে অফিস নিই। তারপর একাধারে ২৫টি ইভেন্ট করে ফেলি। পরে আমরা কর্মী নিয়োগ শুরু করি।
এছাড়া ইকুইটি ইনভেস্টমেন্ট পেয়েছি আমরা শুধু স্টার্টআপ বাংলাদেশ থেকে। মুজিব শতবর্ষে স্টার্টআপ বাংলাদেশ যখন ঘোষণা করে তখন তারা আমাদের ইনভেস্টমেন্ট প্রসেসের জন্য সিলেক্ট করে। এখন পর্যন্ত ওনারা আমাদের ইনভেস্ট করেছে। যদিও এখন দেশি বিদেশি অনেকেই আমাদের এখানে ইনভেস্ট করতে চাইছে, কিন্তু আমরা আমাদের ভিতকে আরও শক্ত করতে চাচ্ছি। আশা করছি আগামী বছর থেকে আমরা বিনিয়োগ নেওয়া শুরু করব।
এছাড়া আমাদের মূলত দুটি সেগমেন্ট থেকে রেভিনিউ (আয়) আসে। প্রথমটা হলো, আমাদের কাউন্সিলিং। করপোরেট ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে কোর্স, কনটেন্ট-সহ বিভিন্ন পরিষেবা থেকে। আরেকটা হলো- বিভিন্ন গ্র্যান্ট বা প্রতিযোগিতা থেকে।
বাংলা ট্রিবিউন: মনের বন্ধুর সুবিধাভোগী কারা?
তৌহিদা শিরোপা: সবচেয়ে বেশি সুবিধা নেয় যাদের বয়স ২০ থেকে ৪৫ -এর মধ্যে। আমাদের এই পরিষেবাটি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে না হলেও বলা যেতে পারে একেবারে নামমাত্র মূল্যে আমরা মানসম্পন্ন পরিষেবা দিয়ে থাকি। আরেকদিক দিয়ে বলা যায়, আমাদের সুবিধাভোগীদের অনেক বড় একটি গ্রুপ হলো তৈরি পোশাক শিল্পের কর্মীরা। এছাড়া তরুণরা অর্থাৎ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। যেহেতু কাউন্সিলিং নেওয়ার মতো আর্থিক সক্ষমতা তাদের তেমন একটা থাকে না, তাই যতটা কমমূল্যে তাদের সেবা দেওয়া যায় ততোটাই আমরা করে থাকি। আমাদের একটি উদ্দেশ্য হলো আর্থিক কারণে একজনও সুবিধা নিতে পারেনি এমন কোনও ঘটনা যেন না থাকে। এছাড়া যেহেতু নারীরা অনেক ক্ষেত্রেই সুবিধা বঞ্চিত তাই তারা যেন এই সুবিধাটি নিতে পারে সেদিকেও আমরা লক্ষ্য রাখি।
বাংলা ট্রিবিউন: আমরা জেনেছি গার্মেন্টস কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আপনারা কাজ করছেন। তাদের কী ধরনের সেবা প্রয়োজন হচ্ছে?
তৌহিদা শিরোপা: গার্মেন্টস শ্রমিকদের মধ্যের বেশিরভাগই তাদের পরিবার থেকে দূরে থাকে। তাই পরিবার থেকে দূরে থেকে তারাও তাদের পরিবার নিয়ে চিন্তিত থাকে। তাদের সন্তান ভালো আছে কিনা, ঠিক মতো পড়াশোনা করছে কিনা, আবার পারিবারিক সম্পর্কগুলো ঠিক আছে কিনা ইত্যাদি- এই বিষয়গুলো তাদের ওপর বেশ প্রভাব ফেলে। অনেক ক্ষেত্রেই তারা এই পারিবারিক বা সম্পর্কের বিষয়গুলো সামলাতে পারে না। এক পর্যায়ে চাকরিও ছেড়ে দেয়। বিশেষ করে পারিবারিক, সামাজিক ও সম্পর্কের জায়গায় তারা বেশ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। তাদের সমস্যা আমাদের মতোই, কিন্তু তাদের ভাষায় বিষণ্নতার ভাব অতোটা বোঝা যায় না। তাদের ক্ষেত্রে এই সার্ভিস বেশ ফলপ্রসূ। বিশেষ করে গার্মেন্টসের মালিকেরা এটা বেশ পছন্দ করে। তারা বলেছে, এতে তাদের শ্রমিকদের কর্মক্ষমতা অনেক বাড়ে। ঝরে পড়ার হারও অনেক কমে যায়। এভাবে আমরা গার্মেন্টসগুলোতে গ্রুপ সেশন করিয়েছি প্রায় ২ লাখ ১০ হাজারের মতো শ্রমিকের, আর একক কাউন্সিলিং করিয়েছি প্রায় ৩৮ হাজারের মতো।
বাংলা ট্রিবিউন: দেশ-বিদেশের বহু অনুষ্ঠানে আপনি যাচ্ছেন, কথা বলছেন। কী বলছেন তরুণদের?
তৌহিদা শিরোপা: আমরা প্রচুর তরুণের সঙ্গে কাজ করি। আমাদের মনের বন্ধুতে অনেক বড় সংখ্যক তরুণ কাজ করে যাদের বয়স ত্রিশের মধ্যে। আমাদের এখানে প্রচুর ছেলে-মেয়ে আসে বিদেশ থেকে ইনটার্নশিপ করতে। এখানে স্কুলের অনেক ছেলেমেয়েরা আসে। তারা নিজেদের এক্সপ্লোর করতে পারে। এখানে আমরা তাদের আগ্রহের জায়গাটা আইডেনটিফাই করি। তরুণদের মাঝে অবসাদের বিষয়টা থাকেই। আমরা তাদের জীবনের ভালো ভালো বিষয়গুলো তুলে আনি। প্রত্যেকের জীবনে ভালো দিক, ভালো সময় থাকে সেগুলোকে আমরা খেয়াল করি না। ফলে হতাশ হয়ে যাই। আমরা চেষ্টা করি সবাই মিলে এর ভেতরে একটা কমফোর্ট সেফ স্পেস তৈরি করতে পারি কি না। আর এজন্য আমরা স্কুল কলেজের বিষয়গুলোকে ঢেলে সাজাচ্ছি। তরুণরা যেন বিষয়গুলোকে তাদের মতো করে বিকশিত করতে পারে। সেটা তার নিজের জন্য এবং অন্যের জন্যও।
বাংলা ট্রিবিউন: মনের বন্ধুকে কোথায় নিতে চান? আর কী কী সেবা যুক্ত করতে চান এতে?
তৌহিদা শিরোপা: দুটো জিনিস করতে চাই। এটা আমার স্বপ্ন। এর একটা হলো বাংলাদেশের মানুষের মন ভালো রাখতে, সুস্থ রাখতে চাই। কারও যদি মন খারাপও হয় সবার আগে তার মনের বন্ধুর কথা মনে হবে। মানসিক স্বাস্থ্যকে এমন সহজ করতে চাই, যাতে এটা নিয়ে অকপটে অন্যসব বিষয়ের মতো কথা বলতে পারে। অ্যাডভান্সড টেকনোলজি ব্যবহার করে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে সব জায়গায় নিয়ে যেতে চাই। টেকনোলজি ও হিউম্যান এনার্জির একটা মেলবন্ধন নিয়ে কাজ করছি এখন আমরা।
এছাড়া মনে বন্ধু একটা গ্লোবাল এনটিটি হবে। এটি শুধু সারা বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয় বরং পুরো পৃথিবীর মানুষের কাছে যেন মনের বন্ধু খুব আপন একটি কিছু হয়। আমাদের দেশেই বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকম ভাষা আছে। আর গোটা পৃথিবীতে তো ভাষার অনেক পার্থক্য। মনের বন্ধু যেন সব ভাষাতেই কনটেক্সচুয়ালাইজ হয়, অ্যাডভান্সড টেকনোলজির মাধ্যমে। পৃথিবীর সব সংস্কৃতির মানুষ যেন এটাকে আপন ভাবতে পারে।
শ্রুতি লিখন: ইশতিয়াক হাসান
কপিরাইটঃ বাংলা ট্রিবিউন