এমপি সার্কেল, সাক্ষাৎকার ও আলোকায়ন ডেক্স:
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন বাড়ছে মৃত্যু। রোগীর আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠছে হাসপাতালের পরিবেশ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ও বছরজুড়ে ডেঙ্গু ঠেকাতে করণীয় প্রসঙ্গে এমপি সার্কেলের সঙ্গে কথা বলেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাখাওয়াৎ হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তামান্ন ইসলাম।
এমপি সার্কেল: চলতি বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ এত বাড়ার কারণ কী? মশার ধরন বা শক্তিতে কোনো পার্থক্য এসেছে কি? এখন বছরজুড়েই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব থাকছে কেন?
ড. মোহাম্মদ সাখাওয়াৎ হোসেন: ডেঙ্গুর প্রকোপ প্রতি বছরই বাড়ছে। যখনই বর্ষা হচ্ছে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা টব, গর্ত, টায়ার ও কনস্ট্রাকশন এলাকায় পানি জমছে। যেখানে পানি বেশি জমছে সেই এলাকাগুলো মশার ভালো ব্রিডিং প্লেস। সেখান থেকে প্রচুর সংখ্যক বংশ বিস্তার করছে। জুন-জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই সময়ে এটা পিক থাকে। তাপমাত্রা কমে গেলে এটা কমে যাবে। স্ত্রী মশা এগ ডেভেলপমেন্টের জন্য মানুষকে কামড়ায়।
‘এক জায়গায় প্রচুর এডিস মশা আছে। প্রচুর মশা আছে বিধায় সেখানে ডেঙ্গু হবে বিষয়টা তা কিন্তু নয়। যেসব মশা ওই ভাইরাসটা বহন করছে, সেসব মশা কামড়ালেই রোগটা হবে। যারা আক্রান্ত হচ্ছে তারাও কিন্তু ভাইরাসটা বহন করছে। তারাও কিন্তু ডেঙ্গু ছড়িয়ে দিতে পারে। এজন্য যারা এ রোগে আক্রান্ত তাদের মশারির ভেতরে রাখতে হয়। এডিস মশা বংশ পরস্পরায় এ ভাইরাস ক্যারি করে। একটা মশা প্রতি বছর ৪-৬টা জেনারেশন দিতে পারছে। এডিস মশার জেনারেশন সাইক্লিক অর্ডারে হচ্ছে। মৌসুম বেসিস হচ্ছে না। আর মশক নিধন কার্যক্রম বছরজুড়ে থাকছে না। ফলে এখন বছরজুড়েই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব থাকছে।’
‘মশা মারার জন্য এখন কেমিক্যাল ব্যবহার করছি। মশা এক ধরনের রেজিট্যান্স তৈরি করছে। হয়তো একটা জেনারেশনের ৫-১০ শতাংশ মশা থাকে খুবই প্রতিরোধী। তারা প্রাকৃতিকভাবে রেজিট্যান্স গ্রো করে। এভাবেই আগের তুলনায় মশার রেজিট্যান্স ম্যাকানিজম বেড়েছে, তারাও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।’
এমপি সার্কেল: ঘর মশামুক্ত রাখা যায় কীভাবে?
ড. মোহাম্মদ সাখাওয়াৎ হোসেন: বাসাবাড়ির জানালায় নেটিং করা যেতে পারে। পাশাপাশি পার্সোনাল হাইজিনের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। অর্থাৎ বাসার ছাদ, টবে যেন পানি না জমতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অ্যারোসল দিলে সব মশা আসলে মরে না। রুমে অ্যারোসল দিয়ে রুম বন্ধ করতে হবে। ১৫ থেকে ২০ মিনিট পরে রুমে গিয়ে সেটা পরিষ্কার করতে হবে। মশা যেগুলো ফ্লোরে পড়ে আছে সেগুলো মেরে ফেলতে হবে। ফ্লোরে পড়ে থাকা মশা যদি না মারা হয় সেখান থেকে ৩০-৪০ শতাংশ মশা অজ্ঞান অবস্থা থেকে উঠে সারভাইব করবে। পরে কিন্তু তারা ওই অ্যারোসলের ডোজে আর মারা যাবে না। কয়েল আমাদের শরীরের অনেক ক্ষতি করে। যেটা আমরা এখন বুঝবো না। ৫-১০ বছর লং টার্ম ব্যবহার করার পর বুঝবো। যেখানে কয়েল ব্যবহার করা হবে সেখানে অবশ্যই বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
এমপি সার্কেল: সিটি করপোরেশন বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করছে। তাতেও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত ফল। ব্যাঙ, গাপ্পি মাছের পর এবার বিটিআই ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে সিটি করপোরেশন, আপনার মতামত কী? উন্নত দেশগুলো কীভাবে মশা নিধন করছে?
ড. মোহাম্মদ সাখাওয়াৎ হোসেন: মশক নিধনে নতুন প্রযুক্তি আসবে। নতুন অনেক ধ্যান-ধারণা আসবে। ট্রায়াল-এরর থাকতে হবে। কোথাও আমরা সফল হবো, কোথাও ব্যর্থতা থাকবে। ১০টা কাজের মধ্যে দেখা যাবে একটায় সাফল্য আসবে। সেই একটা নিয়ে আমাদের এগোতো হবে।
‘এখন ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশার উৎসস্থল ধ্বংসে বাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস (বিটিআই) প্রয়োগ করতে যাচ্ছে সিটি করপোরেশন। এটা মশা-মাছির উৎসস্থল ধ্বংসে সবচেয়ে বেশি কার্যকর। এটা নর্দমার পানিতে ছেড়ে দিলে সেখানে মশার লার্ভাকে বায়োলজিক্যালি কন্ট্রোল করবে বিটিআই। এটা ভালো ব্যবস্থা হতে পারে। এটা সফল হলে নিরাপদভাবে মশক নিধন করা সম্ভব হবে।’
‘উন্নত দেশগুলোতে বছরজুড়েই মশক নিধনের কার্যক্রম চলতে থাকে। মশা নিধনের জন্য তারা বিভিন্ন ধরনের গাছ লাগায় ঘরের আশপাশে। তারা ভিন্ন উপায়ে ফগিং করে। ট্রাকে বা ভ্যাহিকেলের মাধ্যমে তারা ওষুধ স্প্রে করে। হেঁটে হেঁটে ফগিং করলে অনেক ক্ষেত্রেই মশার কাছে ওষুধটা পৌঁছায় না।’
যে ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করা হয় সেগুলো যদি সঠিক পরিমাণে ব্যবহার না করা হয়, অথবা সেগুলোর গুণগত মান যদি ভালো না থাকে তাহলে ফগিং বা লার্ভিসাইড নিধনে ওষুধ ছিটিয়ে কোনো কাজ হবে না। উল্টো মশার রেজিট্যান্স তৈরি হয়। যার কারণে দেখা যায়, আগে যে ওষুধ দিয়ে আমরা মশা মারতে পেরেছি, সেই ওষুধ দিয়ে এখন আর মশা মরছে না।’
এমপি সার্কেল: এডিস মশা নিধনে কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে? নগরবাসীর জন্য কী পরামর্শ থাকবে?
ড. মোহাম্মদ সাখাওয়াৎ হোসেন: বিটিআই ব্যবহার করা হবে, এটা ভালো উদ্যোগ। এর ফলে আমরা লার্ভা কন্ট্রোল করতে পারবো। যদিও এটা ব্যয়বহুল, হয়তো আমাদের বিজ্ঞানীরাও এটা তৈরি করতে পারবেন। ফগারের ক্ষেত্রে ওষুধের মান ও পরিমাণ ঠিক রাখতে হবে। কেবল একটা মৌসুম ধরে নয়, সারাবছর মশক নিধন কার্যক্রম চালাতে হবে। সিটি করপোরেশন, নাগরিক, ভলান্টিয়ার সবাইকে নিয়ে সমন্বিত কার্যক্রম চালাতে হবে।
‘ফগিংয়ের আগে মানুষকে জানাতে হবে। যাতে তারা খাবার ঢেকে রাখতে পারে বা ইনহেলিশন এড়িয়ে চলতে পারে। নাগরিকরদের ঘর, ছাদ, টব কিংবা এসির পাত্রে জমে থাকা পানি পরিষ্কারে উদ্যোগী হতে হবে। হোম নেটিং করা যেতে পারে। তাহলে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত সুরক্ষা পাওয়া যেতে পারে।