এমপি সার্কেল, সুচিকিৎসা চক্র:
চলতি বছর এডিস মশা ভয়ংকর রূপ নেবে বিশেষজ্ঞরা আগেই এমন আভাস দিয়েছিলেন। প্রায় ৩ মাস ধরে ডেঙ্গুর তাণ্ডব সেই প্রমাণই সবার সামনে আসছে। ২৪ ঘণ্টায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যলয়ের এক ছাত্রসহ ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৭৫৭ জন। ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃতদের মধ্যে ৮ জনই ঢাকার। দুজন ঢাকার বাইরের। অপরদিকে ভর্তি রোগীদের মধ্যে ঢাকায় ৮৯২ জন, ঢাকার বাইরের ৮৬৫ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন।
তবে শুক্রবার ঢাকার দুটি সরকারি ও ১৪টি বেসরকারি হাসপাতাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেকে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ও মৃত্যুর কোনো তথ্য দেয়নি।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু দাঁড়াল ২৯৩ জনে। এ ছাড়া হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ৬১ হাজার ৪৭৩ জন। ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে রুদ্র সরকার নামে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত ১২টার দিকে রাজধানীর ধানমন্ডির একটি হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। রুদ্র সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের (২০২১-২২) শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ছিলেন।
এদিকে, ডেঙ্গুর বেসামাল পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো এখন কিছুটা নড়েচড়ে বসেছে। মশা নিয়ন্ত্রণে কড়া নির্দেশা জারি করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এ লক্ষ্যে সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যন্ত মশা নিধনে করণীয় সম্পর্কে ৯ দফা নির্দেশনা দিয়েছে। এছাড়াও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ওই মন্ত্রণালয় পৃথক একটি প্রকল্প প্রস্তাবও তৈরি করেছে।
সূত্র জানায়, সারা দেশে মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে গত সম্প্রতি স্থানীয় সরকার, প ল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় ডেঙ্গুসহ অন্যান্য মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে ৯টি জরুরি নির্দেশনা জারি করে। এরমধ্যে রয়েছে-ওয়ার্ড কমিশনারের নেতৃত্বে সিটি করপোরেশনের প্রত্যেক ওয়ার্ডকে ১০টি জোনে ভাগ করে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করে ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা, ডেঙ্গুসহ অন্যান্য মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে জাতীয় নির্দেশিকা অনুযায়ী জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে মশা নিধন কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি গঠন করে জরুরি ভিত্তিতে কাজ করা। নির্দেশনায় স্থানীয় সরকার বিভাগ ও সিটি করপোরেশনে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপন করে দৈনিক গৃহীত কার্যক্রম স্থানীয় সরকারকে জানাতে বলা হয়েছে। এতে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আঙ্গিনা ও চারপাশের পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি ও শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। নতুন নির্দেশনায় সব সরকারি, আধা-সরকারি অফিস, আবাসিক এলাকা নিজ দায়িত্বে পরিষ্কার রাখা, ডেঙ্গুসহ অন্যান্য মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে সরকারি-বেসরকারি অফিস, আদালত, হাসপাতাল, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আঙ্গিনা ও চারপাশের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার কথা বলা হয়েছে। প্রয়োজনে সিটি করপোরেশনের সহযোগিতায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার তথ্য মন্ত্রণালয় বা বিভাগকে চিঠি দিয়ে জানাতে হবে। কোনো নির্মাণাধীন ভবনে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেলে প্রাথমিকভাবে সতর্ক করতে হবে। নির্দেশনা অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিয়ে প্রয়োজনে নির্মাণকাজ বন্ধ করতে হবে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনসচেতনতা বাড়াতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সহায়তায় মোবাইল ফোনের মাধ্যমে খুদেবার্তা দিতে হবে। ডেঙ্গু মশার হটস্পটগুলোতে তাৎক্ষণিক চিরুনি অভিযান পরিচালনাসহ সিটি করপোরেশন নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা অব্যাহত রাখতে হবে বলেও ওই নির্দেশনায় বলা হয়।
এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. আবু জামিল ফয়সাল যুগান্তরকে বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন দপ্তর থেকে উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ডেঙ্গুতে দৈনিক আক্রান্ত ও মৃত্যুর মিছিল বৃদ্ধি তার প্রমাণ। মূলত প্রশাসনিক পর্যায়ে কোনো মন্ত্রণালয়ের মধ্যেই সমন্বয় নেই। সমন্বয়হীনতা একটি রোগে পরিণত হয়েছে। এজন্য জোরালো নেতৃত্ব দরকার। খোঁজ নিলে দেখা যাবে মশা নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, স্বাস্থ্য বা অন্য মন্ত্রণালয় তা জানেই না। তাই একে অপরের দোষ না ধরে, এককভাবে কাজ না করে সামষ্টিকভাবে কাজ করতে হবে। তবেই সফলতা আসবে। না হলে কোনো কৌশলেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. রাশিদা সুলতানা দাবি করেন, সব দপ্তরের সঙ্গে আলোচনা করেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কাজ চলছে। এখন মশা নিধনে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত হতে হবে। এ জায়গায় সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানিয়েছেন ৯টি পদক্ষপ ছাড়াও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে একটি পৃথক প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। যাতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। এর আওতায় ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের বাহক মশা শনাক্ত করতে ঢাকা মশা নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে একটি সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনা ইউনিট (ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানজমেন্ট ইউনিট) এবং একটি কেন্দ্রীয় জৈবিক (পতঙ্গবিজ্ঞান) ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হবে। প্রকল্পটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়ন বিভাগে পাঠানো হয়েছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে স্থানীয় সরকার বিভাগ। ২০২৮ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত খসড়া প্রস্তাবে মেয়াদ ধরা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানিয়েছে এ প্রকল্পের আওতায় ডেঙ্গু ভাইরাস শনাক্তে বায়োলজিক্যাল ল্যাবে আরটি-পিসিআর থাকবে। ডেঙ্গু শনাক্ত করার জন্য ভেক্টর (মশা), বিশেষ করে এডিস ইজিপ্টাই চিহ্নিত করতে আরেকটি ল্যাব স্থাপন করা হবে। এসব ল্যাবের সঙ্গে সংযোগ রেখে একটি পূর্বাভাস মডেল এবং একটি প্রাথমিক সতর্কীকরণ ব্যবস্থা তৈরি করা হবে। একইসঙ্গে ভেক্টর (মশা) ও রোগ প্রতিরোধে গবেষণা করা হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণের শাখার পরিচালক নাজমুল ইসলাম বলেন, এডিস মশার বিস্তার রোধ এবং ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার বিভাগ বিশেষ করে সিটি করপোরেশনগুলোর সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সহযোগিতা চওয়া হয়েছে। বিশেষ করে, ডেঙ্গুর টিকার বিষয়ে। ডব্লিউএইচও প্রতিনিধি সর্বোচ্চ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।