এমপিসার্কেল, বিবিধ সংযোগ ডেক্সঃ
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এটাই বড় অর্জন৷ এর চেয়ে বড় অর্জন একটি জাতির জীবনে আর কিছু থাকতে পারে না৷।কিন্তু তাতে কী সব কিছু বলা হয়ে যায়? অবশ্যই না। তাহলে বাংলাদেশের অগ্রগতির গতিপথ কী? মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, মানবাধিকার কর্মী, নারী নেত্রী ও অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণের নানা দিক ও মাত্রা আছে। কিন্তু সুশাসন, মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে তাদের অভিমতে অনেটাই মিল। অর্জনের পথে বাধা কোথায়, কার দায় তা নিয়ে নানা মত। কিন্তু অর্জনটা আরো বড় হতে পারত বলে মনে করেন তারা।
অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন অনেক বড়। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় যেতে যোগ্যতা অর্জন করেছে। মানুষের আয় বেড়েছে। বেড়েছে জীবনযাত্রার মান। নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে। শিক্ষার হার বেড়েছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অবনতি হয়েছে, অবনতি হয়েছে মানবাধিকারের। মানবাধিকার কর্মী নূর খান তাই গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার নিয়ে উদ্বিগ্ন।
তবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক আফসান চৌধুরী মনে করেন এটা মধ্যবিত্তের সমস্যা৷ মধ্যবিত্ত তার ক্ষমতা হারিয়েছে। কিন্তু গ্রামের সাধারণ মানুষ এটাকে পাত্তা দেয় না। তাদের অবস্থান আরো সংহত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে গ্রামের এই সাধারণ মানুষই বেশি অংশগ্রহণ করেছেন। তার কথা, ‘‘বিশ্বে এখন রাজনৈতিক রাষ্ট্র পিছিয়ে পড়ছে। এগিয়ে যাচ্ছে অর্থনৈতিক রাষ্ট্র। বাংলাদেশ সেদিকেই যাচ্ছে৷ ফেসবুকের হাহাকার দিয়ে বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা বোঝা যাবে না। সেটা বুঝতে হলে গ্রামের মানুষের সাথে কথা বলতে হবে। আমি তাদের কাছে যাই। তাদের সাথে কথা বলি।’’
অর্থনেতিক বৈষম্য বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিকে শ্লথ করছে: ড. নাজনীন আহমেদ কিন্তু সেটাই কি পর্যাপ্ত? অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ মনে করেন, ‘‘উন্নয়ন হয়েছে। সেটার বড় প্রমাণ আজ আমরা উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। কিন্তু বৈষম্যও বেড়েছে। মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা বেড়েছে। কিন্তু এর সুফল সবাই পাচ্ছে না। অর্থনেতিক বৈষম্য বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিকে শ্লথ করছে। আর এর জন্য দরকার সুশাসন, বিচার ব্যবস্থার উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সাম্য।’’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক মনে করেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন কতটুকু বাস্তবায়ন করা গেছে তার ওপর নির্ভর করে দেশ স্বাধীনতার ৫০ বছরে কতটা এগিয়েছে। তার সেটা বিবেচনা করলে তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে আরো অনেক বাকি। তিনি বলেন,‘‘একটি উদার গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাষ্ট্র নির্মাণে তার যে স্বপ্ন তা বার বার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। দেশ এগিয়েছে। কিন্তু দেশে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিও সক্রিয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তারা তাদের অবস্থান তৈরিতে এখনো সক্রিয়। ফলে জাতির মধ্যে একটা বিভাজন স্পষ্ট। এটার অবসান ঘটা প্রয়োজন। তবে সেটা আপোস করে নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সবখানে প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সম্ভব।’’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. শান্তনু মজুমদার মনে করেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে৷ যুদ্ধাপরাধের বিচার চলমান। এগুলো খুব বড় প্রাপ্তি রাজনৈতিক দিক থেকে। তার কথা, ‘‘একটি ছোট দেশে বিপুল জনসংখ্যা নিয়ে যে অর্থনৈতি অগ্রগতি হচ্ছে সেটা বড় ধরনের সাফল্য।” তবে তিনি মনে করেন,”বাংলাদেশে গণতন্ত্রের যে ঘাটতি সেটাকে বিশ্ব প্রেক্ষাপট থেকে দেখতে হবে। বাংলাদেশে বিগত দুইটি নির্বাচন ভালোভাবে হয়নি। কারা এর জন্য দায়ী তার চেয়ে বড় কথা হলো এখন আমাদের প্রয়োজন রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক উন্নয়ন। আমাদের মনে রাখতে হবে এই ৫০ বছরে আমরা দুইবার দীর্ঘ সময় ধরে সামরিক শাসনের মধ্যে ছিলাম।’’
তার মতে, ‘‘বাংলাদেশের কিছু মানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধটাও নেগোশিয়েবল৷ তারা ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যা কমিয়ে তিন লাখ করতে পারলে খুশি হয়। এই মানসিকতা জাতীয় ঐক্যের পথে অন্তরায়।’’
বাংলাদেশে গণতন্ত্র,মানবাধিকার এবং বিচার ব্যবস্থার এ অবস্থা একদিনে হয়নি। বিভিন্ন সময় যারা দেশ শাসন করেছেন তারা কম বেশি দায়ী। তবে এই সময়ে সঙ্কট সবচেয়ে বেশি বলে মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক নূর খান।
তার মতে,‘‘এখন মানবাধিকার, গণতন্ত্র, ভোটাধিকার ও বাক স্বাধীনতা খুব খারাপ পর্যায়ে রয়েছে। এগুলোর উন্নয়ন না হলে আর কোনো উন্নয়ন টেকসই হয় না।’’
বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে। তাদের শিক্ষার হার বাড়ছে। নারীরা শুধু চাকরি করছেন না , তারা উদ্যোক্তাও হচেছন।
নারী নেত্রী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন,‘‘নারীদের এইসব বিষয়ে উন্নয়ন হচ্ছে৷ তবে এখনো আমরা উন্নত পর্যায়ে পৌঁছতে পারিনি। নারীর প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন বরং আরো বেড়েছে৷ নারী উন্নয়নের স্বাধীন চলকে এখনো পরিণত হতে পারেনি। তাকে এখনো ঠেলে এগিয়ে নিতে হয়। তাই এটাকে আমরা উন্নত অবস্থা বলতে পারি না।’’
দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা,চিকিৎসা খাতেরও উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু এইসব উন্নয়নের বিপরীতে দুর্নীতি আর অর্থ পাচারও বেড়ছে বলে জানান বিশ্লেষকেরা। আর সুশাসনের সংকটের মূলে এটাও বড় কারণ৷ আফসান চৌধুরী মনে করেন, এটা আগেও ছিলো। এখন অর্থনীতি বড় হয়েছে তাই দুর্নীতি আর অর্থ পাচারের পরিমাণও বেড়েছে। তারপরও গ্রাম শক্তিশালী হয়েছে। করোনায় এক কেটি মানুষ গ্রামে গিয়েছে। গ্রাম তাদের আশ্রয় দিয়েছে। শহর কিন্তু পারেনি।
ড. নাজনীন আহমেদের মতে, ‘‘বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে সুশাসনের অভাবই এখন সবচেয়ে বড় বাধা। আর এটার পেছনে রাজনৈতিক নয়, বরং অর্থবিত্তের ক্ষমতাই বেশি সক্রিয়। সব কিছু তাদের কাছে যায়। উন্নয়নের সুফল সাধারণ মানুষের যেভাবে পাওয়ার কথা ছিলো তারা সেভাবে পাচ্ছে না।”