এমপিসার্কেল, জনসংযোগ চক্রঃ
প্রতি বছর ২১ এপ্রিল দিনটি জনসংযোগবিদরা সারা ভারতে ‘জনসংযোগ দিবস’ হিসাবে পালন করেন৷ কারণ, ওই তারিখে, অর্থাত্ ২১ এপ্রিল, ১৯৬৮ সালে নয়াদিল্লিতে, জনসংযোগের ক্ষেত্রে প্রথম পেশাগত সংস্থা, ‘পাবলিক রিলেশনস্ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া’-র প্রথম সর্বভারতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়৷ সেই থেকে ‘পাবলিক রিলেশনস্ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া’ দিনটিকে ‘জনসংযোগ দিবস’ রূপে চিহ্নিত করেছেন৷
পেশাটি সম্বন্ধে এখনও ব্যাপক ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে৷ বহু ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান নিয়োগের জন্য ‘ক্লাসিফায়েড’ বিজ্ঞাপন দেন, ‘টেলিফোন অপারেটর- রিসেপশনিস্ট কাম পিআরও’ চাই বলে৷ অর্থাত্, এগুলি সবই যেন একই কাজ৷ শুধু ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানই বা কেন, মাঝারি ও বড়ো সংস্থাও এই পেশাকে ‘প্রোটোকল’-এর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন৷ পিআরও-কে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের ট্রেন-প্লেনের টিকিট ও হোটেল ‘বুকিং’ বা তাঁদের যাতায়াতের সময় স্টেশন বা এয়ারপোর্ট হাজিরা দেওয়ারকাজে লাগান৷ এই প্রসঙ্গে একটি মজার গল্প চালু আছে৷ একটি সদ্য গঠিত নতুন সংস্থায় কর্মকর্তাদের মধ্যে, তাঁদের পেশা অনুযায়ী ভাগ করে দেওয়া হল৷ তার পরে যে কাজ বা দায়িত্বগুলি বাড়তি রইল অথচ পেশার বিচারে অন্যদের মধ্যে বণ্টন করা যাচ্ছে না, সেগুলি সবই পিআরও-র ঘাড়ে দায়িত্ব হিসাবে চাপানো হল৷
এই প্রসঙ্গে জানাই, প্রতিষ্ঠিত এক বিদেশি জনসংযোগবিদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম এ দেশে পাবলিক রিলেশনস পেশার এই হাল কেন? ভদ্রলোক মুচকি হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘যত দিন না তোমরা বড়োকর্তাদের ‘অ্যাটাচি’ বওয়া বন্ধ করতে পারবে, তত দিন পাবলিক রিলেশনস্ পেশার শ্রীবৃদ্ধিতে যত প্রচেষ্টাই করো না কেন, সফল হতে পারবে না৷’ উত্তর শুনে তাত্ক্ষণিক ভাবে বিমর্ষ হয়ে গেলেও, পরে ভেবে দেখেছি, তিনি ঠিক কথাই বলেছেন৷
ভ্রান্তি এখানেই শেষ নয়৷ বাজারে এমন ধারণার প্রচলন আছে যে, পিআর বা পাবলিক রিলেশনস্ মানে, ‘সাদাকে কালো, বা কালোকে সাদা’ বলে চালানো৷ মানে দাঁড়াচ্ছে, অগুনতি জনগণকে এক জন জনসংযোগবিদ্ যা বোঝাবেন, সবাই তা বিশ্বাস করে নেবেন৷ এটা সম্ভব? জনগণ এতই বোকা? বরং, কোন পিআরও যদি বিন্দুমাত্র এই প্রচেষ্টা করেন, তাঁর এ-কুল ও-কুল, দু’কুলই যাবে৷ চিরকালের জন্য তিনি মানুষের বিশ্বাস হারাবেন৷ এই জন্য, ‘পাবলিক রিলেশনস্’ -কে সংক্ষেপে যে ‘পিআর’ আর একটি রূপ হিসাবে বলা হয়, ‘পারফরমেন্স রেকগনিশন’৷ অর্থাত্, যেটুকু করতে পেরেছ, শুধু সেটুকুরই স্বীকৃতি পাবে৷ ভেজাল মেশাতে গেলেই, ধরা পড়ে যাবে৷
এই প্রসঙ্গে আর একটি কথা মনে পড়ল৷ দীর্ঘ দিন রেলের জনসংযোগের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে, একটা ভুল ধারণার মুখোমুখি হতে হয়েছে বহু বার৷ ভুলটি হচ্ছে, যখনই কোনও ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে, মানুষের, এমনকী, অনেক ক্ষেত্রে সাংবাদিক বন্ধুদেরও মনে ধারণা হয়েছে, আহত-নিহতের সংখ্যা কমিয়ে দেখানো হচ্ছে৷ সেই জন্য, সংবাদপত্রে ‘সরকারি-বেসরকারি মত’ বলে দু’রকম সংখ্যা প্রকাশিত হয়ে থাকে৷ এমনকী, প্রকাশিত সংবাদে স্ববিরোধও লক্ষ করা গেছে৷ এক জায়গায় বলা হচ্ছে, দুর্ঘটনার পরে দীর্ঘক্ষণ রেলের লোকের হদিস মেলেনি৷ আবার পরের প্যারাগ্রাফেই আহত-নিহতের সংখ্যা গোপন করা হচ্ছে বলে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে৷ বহু বার জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করেছি, রেলকর্মীরা পরে এসে, ভিড়ের মধ্যে নিহতদের দেহ কী ভাবে এবং কেনই বা সরাবে? উত্তর আসত, ‘ক্ষতিপূরণ দেবার ভয়’৷ বোঝাতে পারতাম না, পিআরও কেন, কোনও কর্মকর্তার পকেট থেকেই ক্ষতিপূরণের অর্থ দিতে হবে না৷
এখানেই শেষ নয়৷ পিআরও-র আছে উভয় সঙ্কট৷ প্রশাসনের কর্মকর্তারা ওঁত্ পেতে বসে আছেন, ভুল করেও যেন আহত-নিহতের একটাও বাড়তি সংখ্যা না প্রকাশিত হয়৷ তা হলেই চেপে ধরবেন৷ কারণ, কোনও একটা বিপর্যয়ের পরে, কর্মতত্পরতা দেখাবার জন্য, একটা গলা লাগে৷ পিআরও-র গলা সবচেয়ে সহজলভ্য৷
আবার ভ্রান্তি৷ অনেক প্রতিষ্ঠানের ওপরতলার কর্মকর্তাদের ধারণা আছে, জনসংযোগ খুবই সোজা! শুধু সাংবাদিক বন্ধুদের যথেচ্ছ খানা-পিনা করাতে হবে৷ সেই পর্ব মিটলে ‘প্রেস রিলিজ’টা ধরিয়ে দিতে হবে৷ ব্যস, আর দেখতে হবে না৷ সাংবাদিক বন্ধু টলমল করতে করতে অফিসে গিয়ে, ফলাও করে সংবাদটি না লেখা পর্যন্ত ক্ষান্ত হবেন না৷ বোঝাতে পারিনি, কাগজ প্রতি সকালে বাজারে বেচতে হয়৷ সেটা কোনও ‘হাউস জার্নাল’ নয়৷ সংবাদ কেবলমাত্র নিজগুণেই প্রকাশিত হতে পারে৷
দুর্ভাগ্যের এখানেই শেষ নয়৷ প্রতিষ্ঠানে পিআরও-রা প্রায় একঘরে৷ কাজের সুবাদে, জনসংযোগবিদদের ক্ষমতাসীন কর্মকর্তাদের কাছাকাছি থাকতে হয়৷ জনসংযোগ ম্যানেজমেন্ট-এর অঙ্গ হিসাবে গণ্য হওয়ার পরে, জনসংযোগবিদকে ওঠবোস করতে হয় প্রতিষ্ঠানের প্রশাসকদের সঙ্গে৷ ফলে, সহকর্মীরা পিআরও-দের কর্মকর্তাদের ‘চামচে’ বলে দুয়ো দেন৷ আর কর্মকর্তারা মনে করেন, পিআরও হল আজ্ঞাবহ ‘ভৃত্য’৷ যার জন্য প্রায়শই তাঁদের কাছ থেকে হুকুম আসে, ছেলেকে ভালো স্কুলে বা কলেজে ভর্তি করে দিতে হবে৷ স্ত্রী বা মেয়েকে টিভি-তে নাচ-গানের সুযোগ করে নিতে হবে৷ এবং বলা বাহুল্য, অনেক ক্ষেত্রে এর উপরেই পিআরও-র যোগ্যতা নির্ভরশীল৷
ভারতে জনসংযোগের সূচনাকালকে সুদূর অতীত থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ করে দেখানো হলেও, মূল জনসংযোগ প্রথাগত ভাবে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরে পরেই, অর্থাত্ ১৯২০ সাল নাগাদ ভারতীয় রেলওয়ের দ্বারা৷ জনসাধারণের মধ্যে ভারতীয় রেল সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ও রেলকে জনপ্রিয় করে তোলার অভিপ্রায়ে ইংল্যান্ডে গণমাধ্যমের সাহায্যে ও ছাপানো ‘প্যামফ্লেট’ বিতরণের মাধ্যমে প্রচারাভিযান চালানো বা পাবলিক রিলেশানস্ শুরু করেন৷ সেই সময় গঠিত রেলের এই উদ্দেশ্যে ‘পাবলিসিটি ব্যুরো’ একটি সিনেমা তৈরি করে বিভিন্ন জায়গায় দেখিয়ে বেড়াতেন৷ একজিবিশন বা প্রদর্শনীতেও রেল সেই সময় অংশগ্রহণ করেছে৷
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল, এক তালিবান নেতা আমেরিকার সঙ্গে যুদ্ধে নাকাল হওয়ার পর মন্তব্য করেছিলেন, এই ফলের জন্য, অন্য কিছু দায়ী নয়৷ এর মূল কারণ হচ্ছে তাঁদের প্রকৃত জনসংযোগের অভাব৷