এমপিসার্কেল, পরামর্শ চক্রঃ
বহুদিন ধরেই দেশে রাজনীতি বলে কিছু নেই। এক ধরনের রাজনীতিবিহীন পরিস্থিতি চলছে। আমাদের দেশে রাজনীতি বলতে সাধারণত সংসদ এবং মাঠে-ময়দানে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যকার পারস্পরিক সমালোচনা, একে অপরের বিরুদ্ধে সভা-সমাবেশ, মিছিল ইত্যাদি বুঝায়। বিরোধী দলের নানা ইস্যুতে আন্দোলন, অবরোধ ইত্যাদিও এর অন্তর্ভুক্ত। হরতালও রয়েছে। এরশাদ সরকারের পতনের পর এ ধারায় দেশের রাজনীতি পরিচালিত হয়েছে। এ ধারা সুষ্ঠু, নাকি অসুষ্ঠু তা নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন ছিল, এখনও আছে। তবে সচেতন মহল রাজনীতিকে সুষ্ঠু ধারায় পরিচালনার জন্য সবসময়ই পরামর্শ দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন। তারা রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের কথা বলছেন। তার বলছেন, সুষ্ঠু রাজনীতি হচ্ছে, সংসদে কার্যকর বিরোধী দল থাকা এবং তাদের দ্বারা সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের সমালোচনা ও প্রতিবাদ করা। জনসাধারণের বিভিন্ন স্বার্থ, সমস্যা ও দাবী-দাওয়া নিয়ে রাজপথে মিছিল-মিটিং করা। জনগণও সরকার এবং বিরোধী দলের পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করবে। ক্ষমতাসীন দল একচেটিয়া দাবড়ে বেড়াবে না। ক্ষমতার চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স থাকবে। আমাদের দেশে এ ধারার রাজনীতি নেই। ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধী দলের মধ্যে তীব্র বিরোধের রাজনীতিই প্রচলিত। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এ ধরনের রাজনীতি কিছুটা হলেও চালু ছিল। তারপর থেকে রাজনীতির এ ধারাটাও বদলে যায়। রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন দলের একচেটিয়া প্রাধান্য। বিরোধী দলের রাজনীতি এবং তার সুযোগ সীমিত। এ পরিস্থিতিকে পর্যবেক্ষকরা ‘বিরাজনীতিকরণ’ বলছেন। বিরোধী দল থেকে শুরু করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেককে এখন বলতে শোনা যায়, দেশকে বিরাজনীতিকরণ করা হয়েছে। তাদের অভিযোগ ক্ষমতাসীন দলের একচেটিয়া আধিপত্য এবং ধমকের রাজনীতির কারণে বিরোধী দলের রাজনীতি করার সুযোগ নিঃশেষ হয়ে গেছে। বৃহত্তম বিরোধী দলের অভিযোগ, তাদের রাজনীতি করতে দেয়া হচ্ছে না। সভা-সমাবেশ করতে দেয়া দূরে থাক, রাস্তায় মানববন্ধনের মতো নিরীহ কর্মসূচির ক্ষেত্রেও সরকার বাধা দেয়। বিরোধী দলের এ অভিযোগের ভিত্তিতেই হোক বা ক্ষমতাসীন দলের কঠোরভাবে শাসনের কারণেই হোক, দেশে যে একধরণের বিরাজনীতিকরণ পরিবেশ চলছে, তা সচেতন মানুষ মাত্রই উপলব্ধি করছেন। বিরাজনীতিকরণেরএ অভিযোগ ক্ষমতাসীন দল থেকে জোরালোভাবে অস্বীকারও করা হয় না। তার কথাবার্তা ও আচর-আচরণে এ মনোভাবই প্রকাশিত হয়, রাজনীতির যেটুকু সুযোগ দেয়া হচ্ছে, তাই যথেষ্ট। বিরোধী দলের এর বেশি রাজনীতির দরকার নেই। সাধারণ মানুষও সরকারের এ বার্তা বুঝতে পারে। ফলে তারা এখন আর আগের মতো রাজনীতি নিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হয় না। রাজনীতির প্রতি তাদের একধরণের অনীহা কাজ করছে।
রাজনীতির প্রতি আমাদের দেশের মানুষের আগ্রহ চিরন্তন। তারা রাজনীতি সচেতন। খেয়ে হোক, না খেয়ে হোক, রাজনীতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হতে পছন্দ করে। রাজনীতির আলাপ উঠলে তাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেয়। আলোচনা মনপুত হলে মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়, না হলে তর্কে জড়িয়ে পড়ে। তারা ডেমোক্রেসি তত্ত্বের জনক গ্রিক রাজনীতিবিদ ও দার্শনিক ক্লিসথেনিসের নাম বা পরবর্তীতে বিশ্বখ্যাত মনিষীদের দেয়া ডেমোক্রেসির সংজ্ঞা জানা দূরে থাক, নিজেরাই যে ন্যায়-অন্যায় বা যুক্তি-তর্কের মধ্যে লিপ্ত হয়ে ডেমোক্রেসি চর্চা করছে, এটাও তারা জানে না। অজান্তেই তারা ডেমোক্রেসির মধ্যে বিচরণ করে। নীতি-নৈতিকতার মাধ্যমে একের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া বা যৌক্তিক মতামত গ্রহণ করা তাদের চিরকালের অভ্যাস। যেসব রাজনৈতিক দল গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যমে নিজেদের নীতি-আদর্শ সামনে তুলে ধরে, সাধারণ মানুষ তাদের পছন্দ মতো সেসব দলকে সমর্থন করে। এটা অনেকটা এক সময়কার আবাহনী-মোহামেডানকে সাপোর্ট করার মতো। যে দিন প্রিয় দলের খেলা থাকে, সেদিন ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে গ্যালারিতে উপস্থিত হওয়ার মতো পছন্দের রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশে তারা হাজির হয়। প্রতিযোগিতায় হেরে গেলে কষ্ট পায়, জিতে গেলে আনন্দ করার মধ্যে তাদের রাজনীতি সীমাবদ্ধ থাকে। হেরে যাওয়া নিয়ে নানা হিসাব মিলানো এবং জিতে যাওয়া নিয়ে আনন্দ প্রকাশের পাশাপাশি আরও বেশি ব্যবধানে কীভাবে জেতা যেত, এ নিয়ে বিস্তর তর্কবিতর্কে লিপ্ত হয়। মূলত এভাবেই আমাদের দেশের রাজনীতির ধারাটা বহু বছর ধরে প্রচলিত ছিল। এখন তাতে যেন ছেদ পড়েছে। রাজনীতি অনেকটা টেবিলে চাপড় দিয়ে এক হাতে তালি বাজানোর মতো হয়ে পড়েছে। এমন একটা পরিবেশেই দেশকে বিরাজনীতিকরণ করার অভিযোগ উঠেছে। দেশের মানুষ কবে সরকার ও বিরোধী দলের স্বতঃস্ফূর্ত জনসভা দেখেছে, তা মনে করা তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। শীর্ষ নেতাদের সামনা সামনি দেখা বা তাদের কথা শোনার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে কষ্ট করে অতি সাধারণ মানুষের জনসভায় উপস্থিত হওয়ার বিষয়টি হারিয়ে গেছে। ধারাবাহিকভাবে জেলায় জেলায় রাজনৈতিক দলগুলোর বিশেষ করে বিরোধী দলের কবে বড় জনসভা হয়েছে, তা মনে করতে তাদের স্মৃতির গহ্বরে হাতড়াতে হচ্ছে। পত্র-পত্রিকায় জনসভার বিশাল ছবি ও প্রতিবেদন প্রকাশের পাশাপাশি আলাদাভাবে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের কথাও এখন আর চোখে পড়ে না। জনসভা করা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা হয় না। কার জনসভা কত বড় এবং কত মানুষের উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায়, এ নিয়ে কোনো চ্যালেঞ্জ দেখা যায় না। পাল্টাপাল্টি জনসভা করা নিয়ে যে উৎসবমুখর ও প্রতিযোগিতার রাজনীতি দেখা যেত, এখন তা হারিয়ে গেছে। রাজনীতি সচেতন সাধারণ মানুষ হয়তো অগোচরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, কোথায় গেল সেই রাজনীতি! আমরা কেন আর আগের মতো মিটিং-মিছিলে হাজির হতে পারি না, জনসভায় নেতা-নেত্রীদের বক্তব্য শুনতে পাই না। বলার অপেক্ষা রাখে না, সাধারণ মানুষ যে আগের মতো মিটিং-মিছিলে হাজির হতে পারে না, তা দেশ-বিদেশের সকলেরই জানা। রাজনৈতিক দলের জনসভা, মিছিল ও বিভিন্ন কর্মসূচি গণতন্ত্রের অংশ। এখন গণতন্ত্রের এই অপরিহার্য উপাদান দেশে নেই। ফলে অভিযোগ উঠেছে, দেশে বিরাজনীতিকরণ চলছে। বিরোধী দলগুলোকে রাজনীতির ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত স্থান দেয়া হচ্ছে না। অবশ্য ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে বরাবরই বলা হয়, বিরোধী দলের মিটিং-মিছিল, সভা-সমাবেশ নিয়মিতই হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের এ কথার সাথে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী অনেকে একমত নন। তারা অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন, দেশে গণতান্ত্রিক ও স্বাভাবিক রাজনীতির স্পেস সংকুচিত করা হয়েছে। তাদের এসব কথা ক্ষমতাসীন দল খুব একটা আমলে না নিয়েই তার বোধ-বিবেচনায় শাসন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। গণতন্ত্রকে গৌণ করে উন্নয়নকে মুখ্য হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। সরকারের বদ্ধমূল ধারণা, মানুষের সামনে উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরতে পারলে গণতন্ত্র আছে কি নেই, এ নিয়ে তারা খুব বেশি মাথা ঘামাবে না। তবে সরকারের এ নীতির সাথে বেশিরভাগ সচেতন মানুষই দ্বিমত পোষণ করেন। তারা মনে করেন, সুষম ও টেকসই উন্নয়ন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গণতন্ত্রের বিকল্প নেই। উন্নয়ন ও গণতন্ত্র একটি আরেকটির পরিপূরক। একটি বাদ দিয়ে আরেকটি খুব বেশি দিন চলতে পারে না। একটি সফল ও দক্ষ সরকারের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, উন্নয়ন এবং গণতন্ত্রকে সমানতালে এগিয়ে নেয়া। এর যে কোনো একটিকে বাদ দিলে তা তার অদক্ষতা হিসেবে বিবেচিত হয়।
আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, দেশে এখন ভোটাধিকার বলে কিছু নেই। সংসদীয় আসন থেকে শুরু করে স্থানীয় সব নির্বাচনই হচ্ছে। তবে তা কেবল নামকাওয়াস্তে। ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি দেখা যায় না। ভোটের প্রতি মানুষ অনীহ হয়ে পড়েছে। তারা ভাল করেই জানে, ভোট দিয়ে লাভ নেই। তাতে তাদের মতামতের প্রতিফলন ঘটবে না। অনিবার্যভাবেই ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী বিজয়ী হবে। বিরোধী দলের প্রার্থীর ভরাডুবি এমনকি জামানত বাজেয়াপ্ত হবে। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীও জানে, দল থেকে নমিনেশন পাওয়া মানে তার নিশ্চিত জয়। ফলে তাদের প্রার্থীদের মধ্যে ভোটের আগেই নমিনেশন পাওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। নমিনেশন পাওয়া মানেই নিশ্চিতভাবে জিতে যাওয়া। অনেকটা ভোটের আগেই ভোট হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা দাঁড়িয়েছে। বিগত প্রায় এক দশক ধরেই এমন একচেটিয়া ভোটের অপসংস্কৃতি চলছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটা চলছে বিরাজনীতিকরণের ফলে। অন্যভাবে বলতে গেলে, সরকার বিরোধী দলগুলোকে নানা অপবাদ দিয়ে দমন-পীড়ন, হামলা-মামলা দিয়ে নিস্ক্রিয় করতে সক্ষম হয়েছে। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। এ ভয় সাধারণ মানুষের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছে। যেখানে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরাই নানা হয়রানি ও পেরেশানির মধ্যে রয়েছে, সেখানে তাদের সমর্থক ও সাধারণ মানুষ সরকারবিরোধী কথা বলতে গিয়ে পেরেশানির মধ্যে পড়তে যাবে কেন? ফলে তারাও চুপ মেরে গেছে। যেভাবে সরকার চালাচ্ছে, সেভাবেই তারা চলছে। ক্ষমতাসীন দলের কঠোর শাসন-বারণের কারণে সাহস করে এখন কেউ উচ্চকণ্ঠ হতে চায় না। কারণ, বৃহৎ বিরোধী দলকে কীভাবে চিড়েচ্যাপ্টা করে কোনঠাসা করে ফেলা যায় এবং দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত কীভাবে হেনস্থা ও দৌড়ের উপর রাখা যায়, তাদের সামনে এ দৃষ্টান্ত রয়েছে। এ বিবেচনায় সাধারণ মানুষের পক্ষে মুক্তভাবে কথা বলা অত্যন্ত কঠিন। দেখা যাবে, কেউ কিছু বলতে গেলে সরকারের রোষানলে পড়তে হচ্ছে। মাঝে মাঝে কেউ সরকারের সমালোচনা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখি করলে, তার পরিণতি কি হয়, তার অনেক উদাহরণ রয়েছে। ফলে এখন মানুষ অনেকটা পিঠ বাঁচিয়ে চলার মধ্যে রয়েছে। আপনি বাঁচলে বাপের নাম, প্রবাদটি তারা ভালভাবেই মেনে চলছে। ক্ষমতাসীন দল তো বুঝিয়েই দিচ্ছে, রাজনীতি নিয়ে তোমাদের মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। তোমাদের উন্নতির জন্য যা করার দরকার তার সবই করা হচ্ছে। দেশ তরতর করে উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কাজেই এতো রাজনীতি করার দরকার কি! চুপচাপ বসে থাকো! কানো দেশে জনসাধারণের সামনে যখন এমন তথ্য তুলে ধরা হয়, তখন কার সাধ্য, সমালোচনার তীরটি সরকারের দিকে তাক করে? যেখানে রাজনীতিকে ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করা হয়, সেখানে রাজনীতি নিয়ে সাধারণ মানুষের আলোচনা করার কোনো কারণ থাকতে পারে না। অস্বীকার করার উপায় নেই, দেশে যে বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া চলছে, তার সিংহভাগ দায় ক্ষমতাসীন দলের উপরই বর্তায়। এ দায় মোচনের প্রধান দায়িত্বও তার। অন্যদিকে প্রধান রাজনৈতিক বিরোধী দলের প্রজ্ঞাহীন সিদ্ধান্তও ক্ষমতাসীন দলকে কঠোর-কঠিন হওয়ার দিকে ঠেলে দিয়েছে। তাদের রাজনীতির ক্ষেত্র সীমিত করার সুযোগ করে দিয়েছে। দেরিতে হলেও তারা এটা বুঝতে পেরেছে। তারা এখন অনেকটা নিশ্চিত পরাজয় মেনেই সংসদ নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে অংশগ্রহণ করছে। নির্বাচনগুলোতে অংশগ্রহণ করার পক্ষে তাদের যুক্তি হচ্ছে, আমরা দেখাতে চাই, ক্ষমতাসীন দলের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না। বিরোধী দলের এ যুক্তি দেয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। কারণ, দলটির নেতা-কর্মীরা নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয়ে যেভাবে নিস্ক্রিয় ও ঘরে ঢুকে গেছে, তাদের বের করে আনার জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে। হয়তো দলটি মনে করছে, নেতা-কর্মীদের এভাবে চাঙ্গা করতে করতেই একদিন তারা বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া থেকে বের হয়ে আসতে পারবে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, সীমিত, নিয়ন্ত্রিত বা খর্বাকৃতির গণতন্ত্র স্বৈরশাসন থেকেও ভয়ংকর। স্বৈরশাসনে জনসাধারণের সান্ত¦না পাওয়ার জায়গা থাকে। স্বৈরাচার জনগণকে তোয়াক্কা করবে না, এটা তাদের জানা। তবে গণতন্ত্রের লেবাসের শাসন ব্যবস্থা জনগণের জন্য বিপদ বেশি। তারা না পারে কিছু বলতে না পারে সইতে। গণতন্ত্র আছে, গণতন্ত্র নেই-এমন এক গোলক ধাঁধাঁর চক্করে পড়ে তাদের হতাশ হওয়া ছাড়া গতি থাকে না। এ ধরনের শাসন ব্যবস্থা গণতন্ত্রকামী দেশে কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। আমাদের দেশের মানুষও স্বৈরশাসন যেমন মানেনি, তেমনি গণতন্ত্রের মোড়কে আবদ্ধ শাসনও মানেনি। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, তারা দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নিয়ে হলেও গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে, জীবন দিয়েছে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। এ আন্দোলনে যে রাজনৈতিক দলই নেতৃত্ব দিক না কেন, তাতে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে। যারাই গণতন্ত্র ব্যাহত করেছে, তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ আমাদের দেশের মানুষের কাছে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বা উন্নয়নই বড় কথা নয়, তাদের কাছে প্রথম অগ্রাধিকার গণতন্ত্র। এক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর জনসাধারণের চিন্তাভাবনার সাথে তাদের মিল রয়েছে। তারা চায়, শাসন এবং উন্নয়ন দুটোই গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার মধ্যে থেকে হতে হবে। এর বাইরে গণতন্ত্রের নামে কোনো ধরনের চালাকিতন্ত্র তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তারা বিরাজনীতিকরণ পরিবেশে থাকতে চায় না। দেশের জনগণের চিরায়ত এই বৈশিষ্ট্যকে সাময়িকভাবে অনেক শাসক দমিয়ে রাখতে পারলেও শেষ পর্যন্ত তারা জনগণের ইচ্ছার কাছে পরাস্ত হয়েছে। জনগণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত রাজনীতি জনগণের কাছেই ফিরিয়ে দিতে হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে একাধিকবার এ নজির স্থাপিত হয়েছে। গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষ যে আপস করে না, রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে চায়, তা ক্ষমতাসীন দলসহ সকল রাজনৈতিক দল নিশ্চয়ই জানে। কাজেই, ক্ষমতায় যারাই থাকুক না কেন, তাদেরকে বাংলাদেশের মানুষের এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য উপলব্ধি করে দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে দেশ শাসন করতে হবে। বিরাজনীতিকরণ, এক দলের আধিপত্যবাদ, কর্তৃত্ববাদ বা গণতন্ত্রকে বিকৃত করে শাসন করা জনগণ গ্রহণ করে না, এটা বুঝতে হবে। এর পরিণতিও সুখকর হয় না। এক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহণভিত্তিক গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত ও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দেয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। এ বাস্তবতা মেনে নিয়েই গণতন্ত্রকে উন্মুক্ত ও বিকশিত করার উদ্যোগ নেয়া জরুরি। বিরাজনীতিকরণ দেশ ও জনগণের জন্য কখনোই কল্যাণ বয়ে আনে না।